দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সন্ত্রাসী হামলায় ২৯ জনকে হারানোর শোক কাটিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের সাধারণ জনগণ।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে ইংল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের ৪০ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে বলে বিবিসি ও রয়টার্সের প্রতিবেদনগুলোতে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সময় রাত ১০ টায় ভোট গ্রহণ শেষে হবে। শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ আনুষ্ঠানিক ফলাফল জানা যাবে।
এবার নিবন্ধিত ৪ কোটি ৬৯ লাখ ভোটার পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।
২০১৫-র সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটারের সংখ্যা বেশি। সেবার প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ ভোটার তাদের রায় জানিয়েছিলেন।
ভোটারদের অনেকেই এরই মধ্যে পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার এভাবে ভোট দিয়েছিল।
সেবার মোট ৩৩১ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল কনজারভেটিভ পার্টি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবাররা ২২৯টি আসন পেয়েছিল।
এক নজরে এবারের নির্বাচন:
# নির্বাচনের দিন ১৮ বছর বা তার বেশি বয়স হবে এমন যে কেউ ভোটার নিবন্ধন করতে পেরেছেন। এবছর ভোটার নিবন্ধনের শেষ দিন ছিল ২২ মে।
# দেশের বাইরে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা ডাকের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন; তবে ডাকে পাঠানো ভোট অবশ্যই ৮ জুনের আগে কেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়েছে।
# মোট ৬৮টি দলের তিন হাজার ৩০৪ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, যার মধ্যে ১৯১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
# এবার ভোট কেন্দ্র করা হয়েছে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার ও চার্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্যারিশ হলগুলোতে; আগের নির্বাচনগুলোতে এর বাইরে পাব, অত্যাধুনিক লন্ড্রি ও স্কুল বাসগুলোকেও কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। ছবি: রয়টার্স
আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর। কিন্তু ব্রেক্সিট বিষয়ে পার্লামেন্ট সদস্যরা ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে না পারায় হঠাৎ করেই এপ্রিলে আগাম নির্বাচনের ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।
নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগে হতে যাওয়া এবারের নির্বাচনে স্থানীয় কোনো নির্বাচন না হওয়ায় ভোটের ফল দ্রুত পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছে বিবিসি।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের মধ্যেই বেশিরভাগ আসনের ফল জানা যাবে বলেও প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
ব্রেক্সিট বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবার দুই তৃতীয়াংশ আসনের লক্ষ্যে প্রচারে নেমেছিল কনজারভেটিভরা।
শুরুর দিকের জরিপগুলোতে তাদের জনপ্রিয়তা প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির প্রায় দ্বিগুণ দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু নির্বাচন পর্যন্ত সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি মে’র দল। এরই মধ্যে শুরুর তুলনায় তাদের জনপ্রিয়তা ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমে গেছে বলে বিভিন্ন জনমত জরিপের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জরিপে এতটা নিচে নেমে যাওয়ায় কনজারভেটিভ সদরদপ্তর মে-র নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে চিন্তা করছে বলেও জানায় সংবাদ মাধ্যমটি।
তবে জনপ্রিয়তা কমে গেলেও শেষ পর্যন্ত লেবারদের চাইতে বেশ খানিকটা এগিয়েই ছিল কনজারভেটিভ পার্টি।
দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার:
# ১৮ মে কনজারভেটিভরা তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে, যেখানে তারা ‘মূলধারার একটি সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ‘মূলধারার ব্রিটেন’ উপহার দেবে।
# ১৬ মে লেবারদের ইশতেহারে বলা হয়, বছরে ৮০ থেকে এক লাখ ২৩ হাজার পাউন্ড আয় করে এমন ব্যক্তিদের উপর বাড়তি করারোপ করে তা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ যেসব খাতে কৃচ্ছ্রতা সাধন করা হচ্ছিল সেগুলোতে খরচ করবে।
# ১৭ মে লিবারেল ডেমোক্রেটদের ইশতেহার প্রকাশ করা হয়, যেখানে তাদের নেতা টিম ফেরন ব্রেক্সিট বিষয়ে আর একটি গণভোট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেন।
# ৩০ মে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি তাদের ইশতেহারে বলে, ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শেষের পর তারা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে নতুন করে গণভোটের আয়োজন করবে।
# ব্রেক্সিটের পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা ইশতেহারে বলেছে ওয়েলসের প্লাইড সাইমরু, ১৬ মে তারা তাদের ইশতেহার প্রকাশ করে।
# উগ্রপন্থী ইউকেআইপি ২৫ মে তাদের ইশতেহারে বিজয়ী হলে উগ্রবাদী ইসলাম মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দেয়।
# আর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সিন ফেইন ২২ মে তাদের ইশতেহারে আইরিশ রাজনীতিতে ‘নতুন দিগন্ত’ নিয়ে আসার কথা বলেছে।
ব্রেক্সিটের পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরন। ছবি: রয়টার্স
ব্রেক্সিটের পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরন। ছবি: রয়টার্স
২০১৫-র সাধারণ নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ডেভিড ক্যামেরন; কিন্তু ঐতিহাসিক গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় আসার পর তিনি পদত্যাগ করেন।।
তারপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন মে। কিন্তু ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে তার একের পর এক সিদ্ধান্ত বিরোধী লেবার পার্টি, এসএনপি ও অন্যান্য দলের সাংসদদের বিরোধিতায় আটকে যাওয়ায় ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা আরও বাড়াতে’ আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন মে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্যামেরনের নীতিতে তেমন পরিবর্তন আনেননি মে, তবে নতুন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে নিজের মতো করে ব্রিটেনকে সাজাতে পারবেন, এমনটাই প্রত্যাশা তার।
ভোটগ্রহণের আগের দিনও মে বলছেন, তিনিই একমাত্র প্রার্থী যিনি ‘ব্রিটেনের জন্য কিছু করতে পারেন’ এবং সঠিক ব্রেক্সিট চুক্তি তার পক্ষেই আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যে চাকরির পরিমাণ বাড়বে; বাড়বে বাড়িঘর, আরও উন্নত হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
মে’র দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পেছনে আগে যুক্তরাজ্যের যে ব্যয় হত, তা বেঁচে যাওয়ায় ‘বিশাল উপকার’ হবে।
তিনি কনজারভেটিভদের প্রতিশ্রুত ২৩ বিলিয়ন পাউন্ডের ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি ফান্ডের ব্যাপারে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন; বলেন এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যজুড়ে বাড়িঘর, রাস্তা, রেল ও ব্রডব্যান্ড যোগাযোগের উন্নতি হবে।
মে বলেন, বছরখানেক আগে ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছিল।
“আমার পরিকল্পনা সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করা, যেন তা যুক্তরাজ্যের চারদিকে পৌঁছে যায়। ব্রেক্সিটের সুযোগ আমাদের দেবে আরও বেশি চাকরি, আরও বাড়িঘর, ভালো সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং বিশ্বমানের ডিজিটাল যোগাযোগ; যেখানেই আপনি থাকুন না কেনো।”
নরউইচে দেওয়া বক্তব্যে মে বলেন, লেবার সরকার গঠিত হলে দেশের ‘অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে’, অপরদিকে তিনি দেশকে আরও উন্নত করতে চান, যেখানে কোনো সম্প্রদায় পিছনে পড়ে থাকবে না।
তবে ক্যামেরনের কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি থেকে তিনি সরে আসবেন কিনা সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেননি।
এটাকেই প্রচারের ঢাল বানিয়েছে লেবাররা। তাদের মতে, কনজারভেটিভরা নির্বাচিত হওয়া মানে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় মৌলিক নীতিগুলোর অর্থায়নে আরও পাঁচ বছর কাটছাঁট চলবে, যা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোক রুগ্ন করবে এবং বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দেবে।
লেবার পার্টির শীর্ষ নেতা করবিন জোর দিচ্ছেন সরকারি সেবা খাতে কয়েক বিলিয়ন বিনিয়োগের দলীয় পরিকল্পনার উপর।
‘গুটিকয়ের জন্য নয়, অনেকের জন্য’ স্লোগান নিয়ে ভোটের মাঠে থাকা লেবার নেতা ব্যবসায়ী ও বেশি আয়ের মানুষের ওপর উচ্চ হারে করারোপ করে এই অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনার কথা বলছেন।
তিনি বলেন, জাতীয় স্বাস্থ্য খাত আরও পাঁচ বছর অর্থসঙ্কট, কর্মচারী সঙ্কট ও বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না।
শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের নীতিবান্ধব বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত দুই সপ্তাহে অনেক ভোটারের মন জয় করেছে লেবাররা। জনমত জরিপও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নির্বাচনে বিভিন্ন আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৪ বাঙালি প্রার্থীও। যার মধ্যে আছেন গত নির্বাচনে লেবারের টিকেটে বিজয়ী রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক।
সাম্প্রতিক কমেন্ট